তাও বটে, ঠিক কথা, ঠিক কথা! তবে খোক্কস ব্যাটা গেলো কোথায় ! আর সবথেকে বড়ো
আশ্চয্যি হলো যে বীরবালার কাছে যদি তরোয়ালই ছিলো তো খোক্কস তাকে ধরে বেঁধে
আনলো কী করে ?
এসব কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তারা শুনলো খোক্কসের বাড়ির পেছন দিকের ছোট্টো
পুকুরটাতে শব্দ হচ্ছে
“ ঝুপ-ঝুপ-ঝুপ্পুস!”
আর অমনি তার সঙ্গে মিষ্টি মেয়েলি গলায় খিলখিলিয়ে হাসির শব্দ। একটু পরে তার
সাথে যোগ হলো ঘোয়া-ঘোয়া-ঘুঙ-ঘুঙ করে আজব আরেক শব্দ, হাসির না কান্নার বলা
মুশকিল !
রঞ্জনকুমার, চাঁদবুড়ি আর পরী রানী লিং-টিং সেই শব্দ শুনে পড়িমড়ি ছুটে গেলেন
পুকুর ধারে। তারা গিয়ে দেখেন খোক্কস বেচারা একখানা ছিপ হাতে পুকুরের পাশে
কাদায় পড়ে গড়াচ্ছে আর তারই একটু দূরে একখানা ছোট্টো ঝুড়িতে দু-চারখানা মাছ
নিয়ে হেসে কুটোপাটি হচ্ছে রাজকন্যে বীরবালা।
এরা তিনজন তো এক্কেবারে হাঁ করে তাকিয়ে রইলো।
এটা কী হলো! রাজকন্যে আর খোক্কস এমনি করে হাসছে একসাথে !
ওদিকে হলো কী আমাদের খোক্কস ছিলো ভারী লাজুক। রঞ্জনকুমার, চাঁদবুড়ি আর পরী
রানী লিং-টিংকে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে বেচারা ভারী লজ্জাটজ্জা পেয়ে
গিয়ে লুকোলো পুকুরের জলে। কিন্তু অতটুকু ছোট্ট পুকুরে কী আর ওই অ্যাত্তোবড়ো
খোক্কস আঁটে, তোমরাই বলো ? তাই খোক্কসের মুখটুকুই রইলো জলের নীচে, বাকী
শরীরটুকু বিশেষ করে খুদে ন্যাজখানা রয়ে গেলো জলের উপরে....উঁচু হয়ে ।
সে দেখে আবার সব্বাই হেসে উঠলো হো হো করে। তারপর রঞ্জনকুমার দৌড়ে গেল বীরবালার
কাছে,
“ বীরবালা তুমি ভালো আছো তো?”
বীরবালা বললো,
“ ভালো থাকবো না কেন, খুব ভালো আছি।“
“ তবে যে রাজা বীরবাহু বললেন, তোমাকে খোক্কস ধরে নিয়ে গেছে! কিন্তু তুমি তো
এখানে....”
“ বীরবালার তরোয়ালের সামনে দাঁড়াতে রূপকথার দেশের সেরা যোদ্ধারও বুক কেঁপে
ওঠে, তোমার মনে হয় ওই বেচারা খোক্কস আমাকে ধরে আনতে পারবে ?”
“তবে!”
“ আমি সেচ্ছায় সে দেশ ছেড়ে বেড়িয়ে এসেছি। প্রাসাদের বাইরে বেরিয়ে, জঙ্গলে
ঢুকে দেখি খোক্কস লুকিয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে খিদে পেয়েছে বলে। সেখান থেকে তাকে
খাইয়ে দাইয়ে আমি সাথে নিয়ে ঘুরছিলাম। বোধহয় আসার পথে কেউ দেখতে পেয়েছে, আর
তাতেই সবাই জেনেছে যে খোক্কস আমাকে ধরে নিয়ে এসেছে !”
চাঁদবুড়ি বললো,
“ আমি আগেই জানতুম, আমার খোক্কস খোকা বোকা হতে পারে, কিন্তু
দুষ্টু-পাজি-বদমায়েশ সে কক্ষনো নয়।“
পরী রানী লিং-টিংও বললেন,
“ দেখলে রাজকুমার, আমি বলেছিলাম না কোনো গন্ডগোল হচ্ছে কোথাও।“
তাদের কথা শুনে রঞ্জনকুমার বললো,
“ কিন্তু কেন রাজকন্যা? কেন অমনভাবে পালিয়ে এলে তুমি ? আর কদিন পরে বিয়ে
আমাদের, অচিনগড়ের রাজরানী হতে চলেছ তুমি।“
বীরবালা হেসে বললো,
“ চাইনে হতে আমি রাজরানী। তোমাকে চিনিনে জানিনে বিয়ে করবো কেন ? আর তুমিই বা
কী, বিয়ের জন্য হ্যাঁ বললে কেন ?”
“না মানে, বাবা বললেন....”
“ কী বললেন, রাজকন্যের সাথে অর্ধেক রাজত্ব পাচ্ছো, বিয়ে করে নাও! আর তুমিও
অমনি রাজি হয়ে গেলে। তুমি বোঝাতে পারলে না তোমার বাবা কে? কেমন রাজকুমার
তুমি!”
“ কিন্তু রাজকন্যা, এতে অন্যায় কী ?”
“ অন্যায় নেই মানে! যৌতুক দিয়ে বিয়ে করা অন্যায় নয়? রূপকথার দেশ শাসনে
সম্পূর্ণ সক্ষম আমি কেন তোমার রাজপুরী তে গিয়ে ন্যাকা সুয়োরানি সেজে বসে
থাকবো ? আর যে তুমি তরবারি ঠিক করে ধরতে অবধি পারো না, সে হবে আমার দেশের
রাজা!পালিয়েছি বেশ করেছি!”
“ আমি যোদ্ধা নই রাজকন্যা, আমি শিল্পী। এই কী আমার দোষ!”
“ সে কথা নিজের বাবাকে গিয়ে বলো। তুমি শিল্পী তা তোমার দোষ নয়, কিন্তু
শিল্পীর তুলি দিয়ে রাজ্যশাসন করা যায় না কুমার। সেজন্য শস্ত্রবিদ্যা, রণনীতি,
কুটনীতির জ্ঞান প্রয়োজন। যদি সত্যি শিল্পী হয়ে থাকো, তবে সত্যিটুকু বলতে
শেখো। মিথ্যে দিয়ে কোনো শিল্প হয় না।“
“ তাহলে তুমি বিয়েও করতে চাও না !”
“ হয়তো সময়মতো করবো, কিন্তু এখন কখনোই নয়। আমি রাজ্য শাসন করতে চাই, পুরো
পৃথিবী ঘুরে দেখতে চাই, আমি শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা হতে চাই, তারপরে অন্য কিছু নিয়ে
ভাববো।“
রাজকন্যার কথা শুনে রঞ্জনকুমারের যারপরনাই ভালো লেগেছিলো। সত্যিই তো, একটাও কথা
তো ভুল বলেনি বীরবালা। যে মানুষ যে কাজে ভালো, তার তো সেই কাজেই এগিয়ে যাওয়া
উচিত। কেউই কারোর মতো হয় না, কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে একজন ভালো আর
আরেকজন খারাপ। প্রতিটা মানুষ নিজের নিজের মতো করো ভালো।
রঞ্জনকুমার একটু ভেবে বললো,
“ রাজ্য শাসন করো, পুরো পৃথিবী ঘুরে দেখো, শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা হও, কিন্তু তার সাথে
আরেকখানা জিনিস দেব, নেবে বীরবালা?”
“কী?”
“ অচিনপুরের রাজমুকুট ও রাজদন্ড!”
“মানে ?”
“ ভেবে দেখলাম, তোমার মতো শাসনক্ষমতা আমার কক্ষনো হবে না, আর আমি চাইও না শাসন
করতে বা যুদ্ধে যেতে। আমি শিশুদের জন্য পাঠশালা বানাতে চাই বীরবালা,
স্থাপত্যে-ভাস্কর্যে ভরিয়ে তুলতে চাই পুরো অচিনপুর। যাতে কোনো শিশুর ওপর কখনো
অশিক্ষার ছায়া না পড়ে। যাতে শুধু যোদ্ধা বলেই নয়, প্রতিটি রাজ্যবাসী নিজের
গুণের উপযুক্ত সমাদর পায় সমাজে.... তাই বলছি বিয়ে করো বা নাই করো, রূপকথার
দেশের সাথে অচিনপুরেরও শাসন দায়িত্বও নাও তুমি। তার পরিবর্তে এই দুই রাজ্যের
শিক্ষা-শিল্প-সংস্কৃতির দায়িত্ব নিচ্ছি আমি।“
বীরবালা বহু সময় ধরে ভাবলো। আগে যতই রাগ থাকুক না কেন, রাজপুত্র তার জন্য
সাতসমুদ্র তের নদী পেরিয়ে, নিজের প্রাণ হাতে করে এত দূরে এসেছে। সে শিল্পী,
যুদ্ধ জানে না। পথে হাজারখানা বিপদ হতে পারতো, কিন্তু সেসব কিছু কে ভয় পেলেও
নিজের ভয় কে জয় করে রঞ্জনকুমার এতদূর এসেছে। বীরবালা নিজে যোদ্ধা বলেই খুব
ভালো করে জানতো যে শত্রুকে জয় করার থেকেও লক্ষ্যগুণ কঠিন হলো নিজের ভয় কে
যুদ্ধে হারানো। রঞ্জনকুমার তো সেই ভয়কেই জয় করে ফেলেছে, তবে সেই বা যোদ্ধার
থেকে কম হলো কীসে ?
রঞ্জনকুমার আবার প্রশ্ন করলো,
“ বলো বীরবালা, তুমি রাজি ?”
বীরবালা মিষ্টি হেসে বললো,
“ রাজি, রূপকথার দেশের সাথে অচিনপুরেরও দায়িত্ব নেবো, তবে শুধু শাসিকা
হয়ে
নয়, নেবো তোমার রানী হয়ে।“
তারপর, তারপর আর কী, শুভদিনে, শুভক্ষণে রাজকন্যা বীরবালার সাথে বিয়ে হলো
রাজপুত্র রঞ্জনকুমারের। বিয়ের দিন দুই রাজ্যের মানুষ পেট পুরে মন্ডা-মেঠাই
খেয়েছিলো। চাঁদবুড়ি এসে উপহার দিয়েছিলো আলোর সুতোয় বোনা আসমানি রঙের শাড়ি,
মেঘের দল নিয়ে এলো প্রতি বর্ষায় বৃষ্টির আশীর্বাদ, আলো পরীদের সঙ্গে নিয়ে
পরী রানী লিং-টিং দুই রাজ্য ভরিয়ে দিয়েছিলেন রামধনু রঙের আলোয়।
আর খোক্কসের কী হলো?
খোক্কস এসে প্রথম প্রথম ভারী লজ্জা পেয়েছিলো বটে, কিন্তু এত আনন্দ,
জাঁকজমক, মন্ডামেঠাই দেখে সে খানিক পরেই লজ্জা টজ্জা সব ভুলে ধিন-তা-ধিনা-ধেই বলে
নাচতে লাগলো। শুনেছি রূপকথার দেশ আর রাজকন্যা বীরবালাকে তার এমন ভালো লেগেছিলো
যে বিয়ে শেষ হলে পাকাপাকি ভাবে সে রূপকথার দেশেই থেকে গেলো। সব বাচ্চাদের সাথে
মিলেমিশে সেও এখন মন দিয়ে পাঠশালায় “ অ-আ-ক-খ” পড়ে।
কী বললে,একটুও বিশ্বাস হলো না।
বিশ্বাস না হলে আমার কী, রূপকথার দেশের ঠিকানা দিচ্ছি, যাও বাপু নিজের চোখেই
গিয়ে দেখে এসো ...
---সমাপ্ত-
প্রিয় গল্প পড়তে নিয়মিত ভিজিট করুন আমাদের ওয়েবসাইট। ভালো থাকুন।.. Thank
You, Visit Again...
No comments:
Post a Comment