রঞ্জনকুমার চোখ বন্ধ করে ভাবলো ব্যাপারখানা। পরী রানীর কথা তো ভুল নয়। প্রথম কথা
হলো মহারাজ বীরবাহুর কন্যা রাজকুমারী বীরবালা যথেষ্ট সাহসী, অন্যান্য ন্যাকা
রাজকন্যেদের মতো গয়না-শাড়ি-ফুল-প্রজাপ্রতি নিয়ে অনর্থক আদিখ্যেতা করে মিছিমিছি
সময় নষ্ট না সে। মাত্র পঁচিশ বছর বয়সেই রাজনীতি, শস্ত্রবিদ্যা, অর্থনীতি সবকিছু
শিখে নিজেকে রাজ্য শাসনের উপযুক্ত করে তুলেছে। সত্যিকথা বলতে কী রাজকন্যা
বীরবালার সঙ্গে যখন বিয়ের প্রস্তাব এলো, তখন রঞ্জনকুমার ভয় পেয়ে “না” বলে
দিয়েছিলো। আর ভয় পাওয়াটাও স্বাভাবিক, বীরবালা যেমন সুন্দর, সুশিক্ষিতা তেমনি
তরোয়াল চালাতেও ওস্তাদ। তাকে বিয়ে করা যে সে মানুষের কর্ম নয়। কিন্তু পরে পিতা
মেরুসিংহ-র কথায় বুক দুরুদুরু করা স্বত্তেও সে রাজি হয়েছিলো, কেননা রূপকথার
দেশের রাজকন্যা আবার আদ্ধেকখানা দেশ পাওয়া তো চাট্টিখানি কথা নয়।
তারপর মেরুসিংহ আবার বোঝালেন যে বীরবালা যত বড়ো যোদ্ধাই হোক না কেন, বিয়ের পর
তিনি যখন অচিনপুরের রানী হয়ে যাবেন তখন তো আর তাকে যুদ্ধ করতে হবে না।
রাজপ্রাসাদের অন্যান্য স্ত্রীলোকদের মতো তিনিও থাকবেন অন্ত:পুরে। কাজেই যুদ্ধের
কলাকৌশল ভুলে যেতে তার সময় লাগবে না বেশী। আর বিয়ের যৌতুক হিসেবে রঞ্জনকুমার
এমনিতেই আদ্ধেকখানা রূপকথার দেশ পাচ্ছে, আর পরে রাজা বীরবাহুর অবর্তমানে পুরো
দেশেরই অধীশ্বর হয়ে বসবে সে। কাজেই বীরবালার সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাবে হ্যাঁ বলে
দেওয়াই ভালো।
এদিকে রাজা হয়ে রাজ্যশাসন করার ইচ্ছে রঞ্জনকুমারের কোনো কালেই ছিলো না। সে
বেচারা কবিতা লিখতে, ছবি আঁকতে বড়ো ভালোবাসে। কিন্তু পিতা মেরুসিংহকে সে কথা
জানাতে ভয় পায়। বীরবালা কে বিয়ে করার ব্যাপারেও দুমনা হয়ে শেষমেশ পিতার ভয়েই
হ্যাঁ করেছিলো। এরপরই হলো এই বিপদ। এক সপ্তাহ পরে খবর এলো যে, এক দুষ্টু খোক্কস
এসে নাকি রাজকন্যে কে ধরে নিয়ে গেছে। কাজেই কী আর করা, খুব বেশী ইচ্ছে না থাকলেও
রঞ্জনকুমার কে বেড়োতে হলে রাজকুমারী কে উদ্ধার করার জন্যে। নইলে মহারাজ
মেরুসিংহের নাক কাটা যাবে যে ? লোকে কী বলবে !
মুখখানা ব্যাজার করে রঞ্জনকুমার বসে বসে ভাবছিলো এসব কথা। কী দরকার ছিলো বিয়ের
জন্য “হ্যাঁ” বলার। “না” বলে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যেত। এখন কী বিপদ বলো দিকিনি
!রঞ্জনকুমার না পারে এগিয়ে যেতে, না পারবে পিছিয়ে আসতে।
ওদিকে রাজকুমার কে চুপ করে বোকার মতো বসে থাকতে দেখে পরী রানী লিং-টিং বললেন,
“ কুমার,তুমি যদি চাও তো সবকিছু খুলে বলতে পারো আমায়। কোথাও কিছু একটা গন্ডগোল
হচ্ছে। রাজকুমারী বীরবালার নাম আমিও শুনেছি। অমন একখানা বোকাসোকা খোক্কস এসে
অমনি অমনি এক যোদ্ধা রাজকন্যা কে তুলে নিয়ে গেল, একথা বিশ্বাস করা ভারী শক্ত।“
অগত্যা আর কোনো উপায় না দেখে লিং-টিং কে সবকিছু খুলে বললো রঞ্জনকুমার। কারোর
সাহায্য তো নিতে হবেই তাকে। পরী রানী লিং-টিং অবশ্য কথা রাখলেন। সবকিছু শোনার
পর তিনি বললেন,
“ ভয় পেয়ো না কুমার। চলো চাঁদবুড়ির কাছে যাই।“
রাজকুমার বললে,
“ চাঁদবুড়ি কে ?”
“ ওই যে চাঁদে বসে চরকা কাটে যে বুড়ি। পেঁজা তুলোর মতো জ্যোৎস্না চড়কায় ফেলে
ঝলমলে আলোর সুতো তৈরী করে। হাওয়ার মতো হালকা, মুক্তোর মতো ঝকঝকে সাদা, আর
রেশমের থেকেও নরম তেমন সুতো কেউ কোথ্থাও দেখেনি। তারপর সেই সুতো দিয়ে
চাঁদবুড়ি অ্যাই অ্যাত্তো বড়ো বড়ো দুটো রুমাল তৈরী করে প্রতিদিন। রুমাল তৈরী
শেষ হলে, সেই রুমাল দুটো দিয়ে রাত্রিবেলা সুয্যি কে আর দিনের বেলা চাঁদটাকে
বেশ ঝেড়ে-মুছে চকচকে করে রাখে সে। সে জন্যই তো চাঁদ-সুয্যি দুটোই অমন ঝলমল করে
সবসময়। বুড়ি ভীষণ ব্যস্ত থাকে, সময়মতো চাঁদ-সুয্যিটাকে ঝেড়ে মুছে আকাশের
গায়ে টাঙিয়ে দিলে তবেই না দিন-রাত্রি হবে।“
সবকিছু শুনে রাজকুমার বললো,
“ সেসব তো বুঝলাম পরী রানী। কিন্তু চাঁদবুড়ি-র সাথে খোক্কসের সম্পর্ক কী ?”
“ ওমা, বলিনি বুঝি! খোক্কসটার কিনা ছোটোবেলা থেকেই মা-বাবা কেউ ছিলো না তাই
চাঁদ বুড়ি পুষ্যি নিয়েছিলো তাকে। এখন বড় হয়ে গিয়েছে বলে খোক্কস কাঁচ
পাহাড়ে তার নিজের বাড়িতে থাকে। কিন্তু সে বাড়ির চাবি রয়েছে চাঁদবুড়ির
আঁচলে বাঁধা। কিন্তু সাবধান, চাঁদবুড়ি বড়ো সেয়ানা, সে নিজের থেকে না দিলে ওই
চাবি নেওয়ার সাধ্য নেই কারুর, বুঝলে !”
“বুঝলাম। “
অতএব পরী রানী লিং-টিং আর রঞ্জনকুমার দুজনে মিলে চললো চাঁদবুড়ির কাছে। সে
বুড়ি তো কিছুতেই দেখা করবে না তাদের সাথে। চরকা ঘাড়ে তুলে খালি সে এদিক ওদিক
পালানোর চেষ্টা করে।পরী রানী অনেক বলে কয়ে, হাতে-পায়ে ধরে রাজি করালো বুড়ি
কে একটি বার কথা বলার জন্য। পরী রানীর কাকুতি-মিনতি শুনে আর রাজকুমারের করুণ
মুখখানা দেখে বুড়ি চাঁদের মাটির উপর থেবড়ে বসলো আর চরকা চালালো গুরুর-গুরুর-
গুরুর-গুরুর....
No comments:
Post a Comment